তিস্তা ব্যারেজ ও সেচ প্রকল্প



বাংলাদেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্পের তিস্তা ব্যারেজ
লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধা উপজেলাধীন গড্ডিমারী ইউনিয়নের দোয়ানী এবং পার্শ্ববর্তী নীলফামারী জেলার ডিমলা উপজেলাধীন খালিসা চাপানী ইউনিয়নের ডালিয়া- এর মধ্যবর্তী স্থানে তিস্তা নদীর উপর নির্মিত। ডালিয়া নামটি ফুলের মতো হলেও এটি একটি গ্রাম, যা দেখতে কোনো মনোহরিণীর মতো।

সবুজে আচ্ছাদিত এ গ্রামটি আকর্ষণ করে সবচেয়ে পথচারীদের। ভারতের উত্তর সিকিমের পার্বত্য এলাকায় তিস্তার উৎপত্তি। বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে নীলফামারী জেলা দিয়ে। এ নদী বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলের সব কয়টি জেলা অর্থাৎ নীলফামারী,লালমনিরহাট , রংপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধার ওপর দিয়ে প্রবহমান। আশির দশকে লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার দোয়ানীতে তিস্তা নদীর ওপর গড়ে তোলা হয় বাঁধ। যাকে বলা হয় তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্প।
প্রকল্পটি নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলার ৫ লক্ষ ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা প্রদান করে। এর কাজ শুরু হয় ১৯৭৯ সালে এবং শেষ হয় ১৯৯০ সালে। সেচ প্রকল্পটির পরিচালনা ও রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্বে রয়েছে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড।
নদীর মাঝখানে ব্যারাজ। যান্ত্রিক গেট। টানা ৪৪টি গেট একনাগাড়ে। এর আরেক পাশে আছে আরও আটটি গেট। খালে পানি নেওয়ার জন্য। অনেকগুলোই খোলা। তিস্তা নদীর পানিকে নিয়ন্ত্রণ করে, পানি সংরক্ষণ করে শুষ্ক মৌসুমে উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলায় সেচের কাজে লাগানো হয় এই ব্যারাজ দিয়ে। লোহা-লক্কড়, কংক্রিটের বিশাল বিশাল সব কাঠামো। নদীর দুপাশে গড়ে তোলা হয়েছে সবুজ বেষ্টনী।

উত্তরাঞ্চল খরাপিড়িত এলাকা হওয়ায় তৎকালিন বৃটিশ আমলে ১৯৩৭ সালে তিস্তা ব্যারেজ নিমার্ণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।।তবে এর মুল পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় ১৯৫৩ সালে পাকিস্তান আমলে। ১৯৫৭ সালে নির্মাণ কাজ শুরুর পরিকল্পনা থাকলে রাজনৈতিক অস্থিতিলতার কারণে তা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৯ সালে ব্যারেজ নির্মাণের কাজ শুরু হয় এবং ১৯৮৫ সালে সৌদি উন্নয়ন তহবিল ও ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এবং আবুধাবি উন্নয়ন তহবিলের প্রায় ২,৫০০কোটি টাকা ব্যয়ে তিস্তা ব্যারেজসহ সেচ যোগ্য কৃষিজমি ও জলকাঠামো নির্মাণ শুরু হয়। ১৯৯০ সালে এর নির্মাণ কাজ শেষ হয় এবং একই বছর ৫ আগস্ট এর কার্যক্রম চালু হয়। এর মোট নির্মাণ ব্যয়ছিল ১৫শ কোটি টাকা এবং ৫ লক্ষ ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা প্রদান করে।২০১৬ সালে ২৬৬ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করা হয়।

তিস্তা ব্যারেজ ও সেচ প্রকল্প নিয়ে গড়ে উঠেছে বিনোদন স্পট। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর তিস্তার ব্যারেজের উজানে বাঁধ দিয়ে ঘেরা কৃত্রিম জলরাশি, সেচ বাইপাস খাল, বনায়ন আর পাথর দিয়ে বাধাঁনো পাড় সব মিলে এক মনোরম পরিবেশ। শীতকালে এখানে প্রচুর অতিথি পাখির আগমন ঘটে।
কিভাবে যাবেনঃ
রংপুর শহর থেকে ৭৫ কিলোমিটার দূরের এই প্রকল্পে যেতে সময় লাগে দেড় ঘণ্টা। নীলফামারীর ডালিয়ার গাড়িতে চড়ে যাওয়া যায়।
লালমনিরহাট সদর হতে অথবা হাতীবান্ধা উপজেলা সদর হতে সড়কপথে তিস্তা ব্যারেজ এ যাওয়া যায়। হাতীবান্ধা উপজেলা সদর হতে সড়কপথে এর দুরত্ব ২০ কিমি।
যারা ঢাকা কিংবা অন্য শহর থেকে যাবেন তারা সরাসরি যেতে পারেন নীলফামারী। সেখানে স্কুটার, রিক্সা কিংবা মোটরসাইকেলে করে যেতে পারেন তিস্তাপারে।

করমজল



মংলা সমুদ্র বন্দর থেকে সামান্য দূরে পশুর নদীর তীরে ৩০ হেক্টর জমির ওপর বন বিভাগের আকর্ষণীয় এক পর্যটনস্থল করমজল যা সুন্দরবনে অবস্থিত। করমজলকে বন বিভাগ সুন্দরবনের মডেল হিসেবে গড়ে তুলেছে। একদিনে সুন্দরবন ভ্রমণ এবং সুন্দরবন  সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা নেয়ার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান করমজল । 
এখানকার প্রধান প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে হরিণ, কুমির, বানর, কাঠের ট্রেইল, টাওয়ার, নৌকা চালনা, জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য। দেশে প্রাকৃতিকভাবে কুমির প্রজননের একমাত্র কেন্দ্র এখানে অবস্থিত।

নদী পথে খুলনা থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার এবং মংলা থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে এ পর্যটন কেন্দ্রটির অবস্থান। একটি ইকো ট্যুরিজম কেন্দ্র ছাড়াও এখানে আছে হরিণ ও কুমির প্রজনন ও লালন পালন কেন্দ্র। মংলা থেকে ইঞ্জিন নৌকায় চড়লে করমজলের জেটিতে পৌঁছা যাবে এক থেকে দেড় ঘণ্টায়। পর্যটন কেন্দ্রটির শুরুতেই বিশাল আকৃতির মানচিত্র সুন্দরবন সম্পর্কে সাম্যক ধারণা দেবে।
 মানচিত্র পেছনে ফেলে বনের মধ্যে দক্ষিণে চলে গেছে আঁকাবাঁকা কাঠের তৈরি হাঁটা পথ। পথের নাম মাঙ্কি ট্রেইল। এই নামের স্বার্থকতা খুঁজে পাওয়া যায় ট্রেইলে পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গেই। পুরো ট্রেইল জুড়েই দেখা মিলবে সুন্দরবনের অন্যতম বাসিন্দা রেসাস বানরের।
পথের দুই ধারে ঘন জঙ্গল। এ বনে বাইন গাছের সংখ্যা বেশি। কাঠের পথ কিছু দূর যাওয়ার পরে হাতের বাঁয়ে শাখা পথ গিয়ে থেমেছে পশুরের তীরে। শেষ মাথায় নদীর তীরে বেঞ্চ পাতানো ছাউনি। মূল পথটি আরও প্রায় আধা কিলোমিটার দক্ষিণে গিয়ে ছোট খালের পাড়ে থেমেছে। 

পথের মাথায় এখানেও আরও একটি শেইড। সেখান থেকে আবারও পশ্চিম দিকে কাঠের ট্রেইলটি চলে গেছে কুমির প্রজনন কেন্দ্রের পাশে। এই ট্রেইলের মাঝামাঝি জায়গায় নির্মাণ করা হয়েছে একটি পর্যবেক্ষণ বুরুজ। এর চূড়ায় উঠলে করমজলের চারপাশটা ভালো করে দেখা যায়।

কাঠের তৈরি ট্রেইলের একেবারে শেষ প্রান্তে কুমির প্রজনন কেন্দ্র। সেখান থেকে সামান্য পশ্চিম দিকে হরিণ ও কুমিরের প্রজনন কেন্দ্র। সামনেই ছোট ছোট অনেকগুলো চৌবাচ্চা। কোনটিতে ডিম ফুটে বের হওয়া কুমির ছানা, কোনটিতে মাঝারি আকৃতির আবার কোনটিতে আরও একটু বড় বয়সের লোনা জলের কুমিরের বাচ্চা। একেবারে দক্ষিণ পাশে দেয়াল ঘেরা বড় পুকুরে আছে রোমিও, জুলিয়েট আর পিলপিল। 

জেলেদের জালে ধরা পড়া এই তিন লোনা পানির কুমিরকে ২০০২ সালে সুন্দরবনের করমজলে আনা হয়। এই জুটি প্রজননক্ষম হয় ২০০৫ সালে।
বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো কৃত্রিম উপায়ে কুমির উৎপাদনে মূল অবদান তাদেরই। জুলিয়েট আকারে রোমিওর চেয়ে সামান্য ছোট। লোনা পানির এই প্রজাতির কুমির আশি থেকে একশো বছর বাঁচে। জুলিয়েট এ পর্যন্ত ডিম দিয়েছে মোট ৪৮২টি। সেখান থেকে ২৮৪টি বাচ্চা ফুটিয়েছেন বন্য প্রাণী প্রজনন ও সংরক্ষণ কেন্দ্রের কর্মীরা। করমজল বন্য প্রাণী প্রজনন ও সংরক্ষণ কেন্দ্রের আরেক নারী সদস্য পিলপিল। এখন পর্যন্ত সে ডিম দিয়েছে ৪৪টি, যা থেকে বাচ্চা ফুটেছে ৩৩টি।
এর পাশেই চোখে পড়বে চিড়িয়াখানার মতো খাচায় ঘেরা খোলা জায়গা। ভেতরে চিত্রা হরিণ। খাঁচার ভেতরে পশ্চিম কোণে ছোট আরেকটি খাঁচা। ভেতরে রয়েছে কয়েকটি রেসাস বানর।
টিকেট মূল্যঃ
করমজলে দেশি পর্যটকের জন্য প্রবেশ মূল্য জনপ্রতি ২০ টাকা, বিদেশী পর্যটক ৩শ’ টাকা। দেশি ছাত্র ২০ টাকা। দেশি গবেষক ৪০ টাকা। বিদেশী গবেষক জনপ্রতি ৫শ’ টাকা। অপ্রাপ্ত বয়স্ক (বারো বছরের নিচে) দশ টাকা। দেশি পর্যটকের ভিডিও ক্যামেরা ব্যবহারে ক্যামেরা প্রতি ২শ’ টাকা। বিদেশি পর্যটক ৩শ’ টাকা।
উপরের সব মূল্যের সঙ্গে ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রযোজ্য।
কীভাবে যাবেনঃ
রাজধানী ঢাকার গাবতলী ও সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে খুলনা, বাগেরহাটগামী বাস কিংবা কমলাপুর ট্রেনে করে খুলনা আসতে হবে প্রথমে। ঢাকা থেকে সরাসরি বাসে করে বাগেরহাটে পৌছাতে পারবেন। ঢাকা থেকে বাগেরহাটে চলাচলকারী বাসগুলো যা সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে ছেড়ে যায়। এছাড়া ঢাকার গাবতলি বাস টার্মিনাল থেকে ছাড়ে।
খুলনা থেকে রুপসা বা বাগেরহাটের মংলা বন্দর থেকে লঞ্চ পাবেন। এছাড়া বাগেরহাটের মংলা, মোরেলগঞ্জ, শরণখোলা থেকে পাবেন সুন্দরবনে যাওয়ার নৌযান পাওয়া যায়।করমজল যেতে হয় পশুর নদী পাড়ি দিয়ে। এই নদী সবসময়ই কম-বেশি উত্তাল থাকে। তাই ভালো মানের ইঞ্জিন নৌকা নিয়ে যাওয়া উচিৎ। আগেই নিশ্চিত হয়ে নিন নৌকায় পর্যাপ্ত লাইফ জ্যাকেট আছে কিনা।
বিঃদ্রঃ বন রক্ষী ছাড়া জঙ্গলের ভেতরে ঢুকবেন না। হরিণ ও কুমির প্রজনন কেন্দ্রের কোন প্রাণীকে খাবার দিবেন না

নিঝুম দ্বীপ (চর ওসমান)



বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে, নোয়াখালী জেলার দক্ষিণ অংশ বেয়ে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় জেগে ওঠা দ্বীপের সমষ্টি। বল্লার চর, কামলার চর, চর ওসমান ও চর মুরি এই চারটি প্রধান দ্বীপ ও বেশ কয়েকটি ছোট চর সমন্বয়ে সর্বমোট প্রায় ১৪,০৫০ একর এলাকা নিয়ে গঠিত এই দ্বীপাঞ্চলটি ১৯৫০-এর শুরুর দিকে জেগে ওঠে। প্রথমে স্থানীয় জেলেরা দ্বীপটি আবিষ্কার করে। তারা এর নাম দেয় বালুয়ার চর, যা পরবর্তীতে বল্লার চর-এ রূপান্তরিত হয়। শীতকালে এখানে হাজার হাজার অতিথি পাখির সমাবেশ ঘটে। জেলেদের ধরা নানারকম মাছ শুকানোর জন্য এটি একটি আদর্শ স্থান হিসেবে ব্যবহƒত হতে থাকে। তাদের অনেকে এখানে অস্থায়ী খড়ের ঘরও নির্মাণ করে।

চরাঞ্চলটি খুব দ্রুতই নতুন ঘাসে ভরে যায়। আশেপাশের লোকালয় থেকে লোকেরা নদী বেয়ে এখানে গরু-মহিষ চরাতে আসা শুরু করে। পরবর্তীতে একসময় জরিপ দল এসে গোটা চরাঞ্চলের মাপ-জোঁক নথিবদ্ধ করে। অনেকের মতে এই দ্বীপাঞ্চলে প্রথম বসতি গড়া জনৈক ওসমানের নামে জরিপকারীরা এর নাম দেয় চর ওসমান।
চর ওসমানে প্রায় নিয়মিতই প্রচুর মানুষ গরু-মহিষ চরানোর জন্য আসা-যাওয়া করলেও ১৯৭০-এর আগে এখানে কোন স্থায়ী বসতি স্থাপিত হয় নি। মাঝেমাঝে মৌসুমি তথা অতি অস্থায়ী কিছু বসতি থাকলেও সমগ্র দ্বীপাঞ্চল বছরের অধিকাংশ সময়ই জনবিরল থাকত। একারণে এটি নিঝুম দ্বীপ নামেও পরিচিত হয়ে ওঠে। 
১৯৭০-এর দশকের শুরুর দিকে নিঝুম দ্বীপ হাতিয়া নির্বাচনী এলাকার অন্তর্ভুক্ত হয়। এসময় নিকটবর্তী হাতিয়া, শাহবাজপুর, রামগতি প্রভৃতি এলাকা থেকে নদীভাঙনের কারণে গৃহহীন লোকজন নিঝুম দ্বীপে এসে বসবাস শুরু করে।
নিঝুম দ্বীপে ছোট বড় বাজার আছে। বাজারগুলিতে প্রধানত চাল-ডাল ও ঔষধের দোকান, মনোহারী সামগ্রীর দোকান ও কিছু খাবারের দোকান আছে। 
বাংলাদেশ সরকারের বন বিভাগ নিঝুম দ্বীপে উপকূলীয় বনাঞ্চল গড়ে তুলেছে। এখানকার বন এলাকায় চিত্রা হরিণ আছে। গাছগাছালির মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গাছ কেওড়া, যা স্থানীয়ভাবে কেরফা নামে পরিচিত। এই গাছ দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং এর সম্প্রসারিত মূল ভূমিক্ষয় রোধ করে। এছাড়া এই গাছের কাঠ দিয়ে বাড়িঘরের খুঁটি, নৌকা, চাষাবাদের উপকরণ ইত্যাদি তৈরি হয়, জ্বালানি হিসেবেও এর ব্যবহার হয়। ২০০১ সালে বাংলাদেশ সরকার নিঝুম দ্বীপের বনাঞ্চলকে জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করেছে।

অধিবাসীদের প্রধান পেশা কৃষিকাজ, মাছ ধরা ও পশুপালন। এই দ্বীপে প্রচুর শাকসবজির চাষ হয়। এখানে জীবনযাপন কঠিন ও খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। দ্বীপের অধিবাসীরা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মাথায় নিয়েই বসবাস করে। তারপরও প্রতি বছরই মূল ভূখণ্ড থেকে অনেক লোক বসবাসের জন্য এখানে আসে।
প্রায় ৯১ বর্গ কিমি আয়তনের নিঝুম দ্বীপে ৯টি গুচ্ছ গ্রাম রয়েছে। এই গুচ্ছ গ্রাম ছাড়াও বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ছোটখাটো ঝুপড়ি ঘর। ১৯৯৬ সালের হিসাব অনুযায়ী নিঝুম দ্বীপ ৩৬৯৭০.৪৫৪ হেক্টর এলাকা জুড়ে অবস্থিত। 

নিঝুম দ্বীপে হরিণ এবং মহিষ ছাড়া অন্য কোনো হিংস্র প্রাণী নেই। হরিণের সংখ্যা প্রায় ২২,০০০ (প্রেক্ষাপট ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দ)। নিঝুম দ্বীপে রয়েছে প্রায় ৩৫ প্রজাতির পাখি। এছাড়াও শীতের মৌসুমে অজস্র প্রজাতির অতিথির পাখির অভয়ারণ্যে পরিণত হয় নিঝুম দ্বীপ। নিঝুম দ্বীপে বিশাল এলাকা পলিমাটির চর। জোয়ারের পানিতে ডুবে এবং ভাটা পড়লে শুঁকোয়। এই স্থানগুলোতে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির পাখিদের বসবাস। জোয়ারের পানিতে বয়ে আসা বিভিন্ন প্রজাতির মাছ এদের একমাত্র খাবার। 
এখানে রয়েছে মারসৃপারি নামে একধরনের মাছ যাদেরকে উভচর প্রাণী বলা হয়। ৫ বছর পর্যন্ত বাঁচে এই মারসৃপার, ৬-৯ ইঞ্চি লম্বা হয়। বর্ষা মৌসুমে ইলিশের জন্য নিঝুম দ্বীপ বিখ্যাত। এই সময় ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পাইকাররা নিঝুম দ্বীপে মাছ কিনতে আসে। 
এছাড়া শীত কিংবা শীতের পরবর্তী মৌসুমে নিঝুম দ্বীপ চেঁউয়া মাছের জন্য বিখ্যাত। জেলেরা এই মাছ ধরে শুঁটকি তৈরি করেন। এই শুঁটকি মাছ ঢাকা, চট্টগ্রাম, চাঁদপুরসহ বিভিন্ন অঞ্চলের পাইকারদের কাছে বিক্রি হয় ৩০-৩৫ টাকা কেজি দরে। আবার এই শুঁটকি হাঁস-মুরগীর খাবারেও ব্যবহার করা হয়। নিঝুম দ্বীপে রয়েছে কেওড়া গাছ। ইদানিং বনবিভাগ কিছু নোনা ঝাউও রোপণ করছে। এছাড়াও রয়েছে প্রায় ৪৩ প্রজাতির লতাগুল্ম এবং ২১ প্রজাতির অন্যান্য গাছ।

যাতায়ত ব্যবস্থাঃ
ঢাকার সদরঘাট থেকে প্রতিদিন লঞ্চ হাতিয়ার উদ্দেশে ছাড়ে। সময়মতো লঞ্চ ছাড়লে এবং আবহাওয়া ঠিক থাকলে ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া লঞ্চটি পরদিন সকালে হাতিয়া লঞ্চঘাটে পৌছবে। এ ছাড়া বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সদরঘাট থেকেও চট্টগ্রাম থেকে জাহাজ হাতিয়ার উদ্দেশে ছেড়ে যায়।
অন্যান্য অঞ্চলের সাথে যোগাযোগ করতে হলে জোয়ার ভাটার উপর নির্ভর করতে হয় নিঝুম দ্বীপের মানুষদের। হাতিয়া, ভোলা কিংবা ঢাকার সাথে যোগাযোগ করতে হলে তাদেরকে পুরোপুরি জোয়ার ভাটা মেনে চলতে হয়। ঢাকায় যেতে হলে তাদেরকে সকালে (জোয়ার আসার)পর হাতিয়ার উদ্দেশ্য যাত্রা করতে হয়। প্রায় ২-৩ ঘণ্টা সময় পর ট্রলার হাতিয়া পৌঁছায়।
ট্রেনে করে যেতে চাইলে প্রথমে কমলাপুর রেলওয়ে ষ্টেশন থেকে নোয়াখালী রেলওয়ে ষ্টেশন যেতে হবে। এরপর বাসে নোয়াখালী চেয়ারম্যান ঘাট হয়ে উপরের রুট অনুযায়ী নিঝুম দ্বীপে যাওয়া যায়।
ঢাকা থেকে সড়ক পথে যেতে চান তাদের জন্য ঢাকার যাত্রাবাড়ী তথা সায়েদাবাদ থেকে রয়েছে নোয়াখালীর বাস। ঢাকা থেকে প্রথমে যেতে হয় মাইজদী সোনাপুর। সোনাপুর থেকে যেতে হবে চেয়ারম্যান ঘাট। সোনাপুর থেকে চেয়ারম্যান ঘাটের দূরত্ব প্রায় ৪০ কিলোমিটার। যানবাহন হিসেবে রয়েছে বাস, টেম্পু ও টু-স্ট্রোক বেবিট্যাক্সি। চেয়ারম্যান ঘাট পৌছে সেখান থেকে ইঞ্জিন চালিত ট্রলার অথবা সী ট্রাকে করে প্রথমে হাতিয়া চ্যানেল পাড়ি দিয়ে যেতে হয় হাতিয়ার নলচিরা ঘাটে। তারপর নলচিরা ঘাট থেকে যেতে হয় দক্ষিণদিকে জাহাজমারা নামক ঘাটে। সময় লাগে ৩০ মিনিটের মতো। আবার জাহাজমারা থেকে ইঞ্জিন চালিত নৌকায় করে যেতে হয় নিঝুম দ্বীপে। তবে, দলবেধে গেলে সরাসরি চেয়ারম্যান ঘাট থেকে ট্রলার রিজার্ভ করে নিঝুম দ্বীপে যাওয়া যায়। উল্লেখ্য এই পথে নিঝুম দ্বীপে যাওয়ার সময় জোয়ারের জন্য অপেক্ষা করতে হয়।
কোথায় থাকবেনঃ
নিঝুম দ্বীপে পর্যটকদের থাকার জন্য অবকাশ পর্যটন নির্মাণ করেছে নিঝুম রিসোর্ট এবং নামার বাজার মসজিদ কতৃপক্ষ নির্মাণ করেছে মসজিদ বোর্ডিং।
নিঝুম রিসোর্ট। এছাড়া ও অনেক রিসোর্ট রয়েছে।

মাধবকুন্ড ঝর্ণা


মাধবকুন্ড ঝর্ণা যা বাংলাদেশের সুউচ্চ জলপ্রপাত হিসেবে পরিচিত। সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা নামক উপজেলায় এই সুন্দর নয়নাভিরাম জলপ্রপাতটির অবস্থান। একসময় পর্যটকদের কাছে প্রাকৃতিক জলপ্রপাত মানেই ছিলো মাধবকুন্ড। এখন দেশের ভেতরে আরো অনেক ঝর্ণার সন্ধান মিলেছে। তবে এখনো জলপ্রপাত অনুরাগী পর্যটকদের প্রধান আকর্ষন মাধবকুন্ড ঝর্ণা।
 পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে দেশে-বিদেশে পরিচিত এই স্থানটিতে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের রেস্টহাউজ ও রেস্টুরেন্ট নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া সরকারি উদ্যোগে পুরো এলাকাটিকে ঘিরে তৈরি করা হচ্ছে মাধবকুণ্ড ইকোপার্ক।

যে পাহাড়টির গা বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে এ পাহাড়টি সম্পূর্ণ পাথরের যা পাথারিয়া পাহাড় (পূর্বনাম: আদম আইল পাহাড়) নামে পরিচিত। এর বৃহৎ অংশজুড়ে রয়েছে ছড়া। এই পাহাড়ের উপর দিয়ে গঙ্গামারা ছড়া বহমান। এই ছড়া মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত হয়ে নিচে পড়ে হয়েছে মাধবছড়া। অর্থাৎ গঙ্গামারা ছড়া হয়ে বয়ে আসা জলধারা [১২ অক্টোবর ১৯৯৯-এর হিসাবমতে] প্রায় ১৬২ ফুট উঁচু থেকে নিচে পড়ে মাধবছড়া হয়ে প্রবহমান। সাধারণত একটি মূল ধারায় পানি সব সময়ই পড়তে থাকে, বর্ষাকাল এলে মূল ধারার পাশেই আরেকটা ছোট ধারা তৈরি হয় এবং ভরা বর্ষায় দুটো ধারাই মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় পানির তীব্র তোড়ে।

জলের এই বিপুল ধারা পড়তে পড়তে নিচে সৃষ্টি হয়েছে বিরাট কুণ্ডের। এই মাধবছড়ার পানি পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হতে হতে গিয়ে মিশেছে হাকালুকি হাওরে। মাধবকুন্ড ঝর্ণা থেকে ১৫-২০ মিনিটের হাটা দুরত্বে রয়েছে আরেকটি ঝর্ণা যা পরিকুন্ড ঝর্না নামে পরিচিত।
মাধবকুন্ড ঝর্ণাতে আসার পথে চোখে পড়বে উঁচু নিচু পাহাড়ি টিলায় দিগন্তজোড়া চা বাগান। টিলার ভাঁজে ভাঁজে খাসিয়াদের পানপুঞ্জি ও জুম চাষ। মাধবকুন্ড ঝর্ণার (Madhobkundo Waterfall) পাশেই রয়েছে কমলা বাগান, চা, লেবু, সুপারি ও পানের বাগান। ফলে মাধবকুন্ড বেড়াতে গেলে সহজেই ঘুরে আসা যায় এসব বাগানে।
মাধবকুন্ড যাওয়ার উত্তম সময় হচ্ছে বর্ষাকাল। এ সময় ঝর্ণা পানিতে পূর্ণ থাকে।

বাইক্কা বিল





মাছ ও পাখির অভয়াশ্রম এ বাইক্কা বিল। ঢাকা থেকে ২০০ কিমি. উত্তর-পূর্বে মৌলভীবাজার জেলার অন্তর্গত শহর শ্রীমঙ্গল। এ শহরের ৬০০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে হাইল হাওর। এর পূর্বদিকে ১০০ হেক্টর এলাকা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এ অভয়াশ্রমটি। 

মার্কিন সাহায্য সংস্থা ইউএসএইডের সাহায্য এবং স্থানীয় প্রশাসন ও জনগণের সহযোগিতায় গড়ে ওঠা এ অভয়াশ্রমই ঐতিহাসিকভাবে দেশীয় মাছের বংশ বিস্তারে প্রথম এলাকা। রাজিব পালের বর্ননায় শোনা যাক বাইক্কা বিলের বিস্তারিত

শহর ছাড়িয়ে গাড়ি নামল কাঁচা রাস্তায়। এবড়োথেবড়ো পথে গাড়ি চলছিল হেলেদুলে। পেছনের ছিটে বসে প্রায়ই লাফিয়ে উঠছিলাম। কিন্তু নির্জন পথের সৌন্দর্যও কম ছিল না। পড়ন্ত বিকালে জেলেরা ফিরছিল মাছ নিয়ে। কী মাছ ধরেছেন জানতে চাইলে এক জেলে খলুইয়ের ঢাকনা সরিয়ে দেখাল চিতল, টাকি আর তেলাপিয়া মাছ।

 দিন শেষে কিছু রোজগারের প্রত্যাশায় তার ঠোঁটের এক চিলতে হাসি বিকালের কমলা রঙের রোদের মতোই সুন্দর লাগছিল। হাওরে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ল সবুজ কচুরিপানার ভেতরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা বেগুনিরঙা ফুলদের। হাওর হচ্ছে এমন একটি এলাকা যা দুটি নদী প্রবাহ এলাকার মাঝের নিচু প্লাবন ভূমি। এ অঞ্চল বর্ষায় সম্পূর্ণ প্লাবিত হলেও শীতে আবার শুকিয়ে যায়। গাড়ি থেকে নামতে হল বেশ খানিকটা দূরেই। যান্ত্রিক শব্দ যাতে নির্জনতা ভঙ্গ না করে সে জন্যই এ ব্যবস্থা। হাওরের ভেজা জলাভূমিতে পা রাখতেই দৃষ্টি কেড়ে নিল বাহারি পদ্ম ও শাপলা ফুল। হঠাৎই ডানা ঝাঁপটিয়ে আকাশে উড়াল দিল এক ঝাঁক পাখি। দূরে গোল পদ্মপাতা আর গোলাপি পদ্ম ও সাদা শাপলার ভিড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি যেন হাতছানি দিয়ে ডাক দিল। নাহ্! এ সৌন্দর্য কি দূর থেকে দেখা যায়! আমরা ডিঙি নৌকায় উঠলাম মাছ, পাখিদের কাছে যাব বলে। নৌকায় ভেসে যেতে যেতে আমরা দেখলাম ঝাঁকে ঝাঁকে ল্যাঞ্জা হাঁস, গিরিয়া হাঁস, ভুতিহাঁস, পাতি সরালি, দাপটে সাঁতার কাটছে রাজ সরালি। এছাড়াও আছে পানকৌরি, কানি বক, সাদা বক, নীল সুন্দর কালিম, টিটি ও ঈগল। আছে শামুকভাঙা পাখির দল। 

তবে মুশকিল হচ্ছে কাছে গেলেই পাখিগুলো উড়ে পালায়। ফিরতে ফিরতে দেখছিলাম মাছ নির্ভয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। বিভিন্ন প্রজাতির মাছের বংশ বিস্তারের জন্য নানারকম ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। মা মাছ যাতে নিরাপদে ডিম ছাড়তে পারে সে জন্য পানির ভেতর সিমেন্টের মোটা পাইপ বসানো আছে। বিলের ভেতর কত রকম যে জলজ উদ্ভিদ। নানারকম পাখির বিষ্টার কারণে এগুলো দ্রুত বাড়তে থাকে। আর সেগুলোই খেয়ে বাড়তে থাকে তৃনভোজি পাখি ও মাছ।

নৌকা পাড়ে ভিড়তেই চোখে পড়ল কাদা-মাটিতে বেড়ে ওঠা ঘাস-জঙ্গলের ভেতর সোনার নাকফুলের মতো উঁকি দিয়েছে ছোট্ট গোল গোল হলুদ ফুল। বিলের পাড়েই নির্মাণ করা হয়েছে একটি উঁচু পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। দর্শনার্থীরা সেখানে উঠে পাখি দেখে থাকে। বিলের রক্ষণাবেক্ষণকারী মিন্নত আলী আমাদের নিয়ে উঠলেন টাওয়ারে। ওপরে দুটি দূরবীন আছে। যার একটা এরই মধ্যে বিকল হয়ে আছে। টাওয়ারের ওপরের উঠে বিলটাকে আরও সুন্দরভাবে দেখা গেল। 

উঁচু থেকে হাওর অঞ্চলের অনেকটাই দেখা যায়। মিন্নত আলীর কাছে জানা গেল, মানুষের কোলাহলে এবং নানারকম কর্মকাণ্ডে কমে গিয়েছিল হাওরের অতিথি পাখি। কিন্তু অভয়াশ্রম করার পর সেইসব পাখি আবার ফিরতে শুরু করেছে। বিলের পাশের হিজল-করোচের বনে বাসা বেঁধে বাচ্চা দিতে শুরু করেছে মুখচেনা পাখিরা। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতেই পাখির কিচির-মিচিরে মুখরিত হয়ে উঠল পুরো এলাকা। কাগজে এর আগে বহুবার ছবি দেখেছি বাইক্কা বিলের পাখিদের। বর্ণনাও পড়েছি। অথচ নিজে চোখে দেখার অনুভূতি যেন একেবারেই অন্যরকম। একবার গেলে বুঝবেন, প্রকৃতি আমাদের কতটা উজ্জ্বীবিত করে। কর্মব্যস্ততার অবসরে একটা দিন না হয় কাটিয়ে গেলেন মাছের সঙ্গে, পাখিদের সঙ্গে। পাখির গান শুনতে শুনতে বন্য ফুলের গন্ধে মেতে উঠতে উঠতে মনে হবে জীবনটা এত সুন্দর!

শাহ সুজার তোহাখানা (চাঁপাইনবাবগঞ্জ)


শাহ সুজার তোহাখানা একটি তিনতলা বিশিষ্ট রাজ প্রাসাদ। তোহাখানা ফার্সি শব্দ, যার আভিধানিক অর্থ ঠান্ডা ভবন বা প্রাসাদ। গৌড়-লখনৌতির ফিরোজপুর এলাকায় একটি বড় পুকুরের পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত ভবন কাঠামোটি ঐতিহ্যগতভাবে তোহাখানা নামে পরিচিত। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে প্রায় ৩৫ কি.মি. দূরেুত্বে অবস্থিত শিবগঞ্জ উপজেলার শাহাবাজপুর ইউনিয়নে ঐতিহ্যবাহী তোহাখানা কমপ্লেক্স বা তোহাখানা অবস্থিত।
বঙ্গ সুলতান শাহ সুজা তাঁর মুর্শিদ সৈয়দ নেয়ামতউল্লাহ এর উদ্দেশ্যে শীতকালীন বাসের জন্য ফিরোজপুরে তাপনিয়ন্ত্রণ ইমারত হিসেবে এ ভবনটি নির্মাণ করেছিলেন। সময়ে সময়ে শাহ সুজাও এখানে এসে বাস করতেন। বিভিন্ন ঐতিহাসিক গ্রন্থ হতে জানা যায়, মুঘল সম্রাট শাহজাহানের পু্ত্র শাহ্ সূজা বাংলার সুবাদার থাকাকলে ১৬৩৯-১৬৫৮ খ্রিঃ মতান্তে ১৬৩৯-১৬৬০ খ্রিঃ তাঁর মুরশিদ হযরত শাহ সৈয়দ নেয়ামতউল্লাহর প্রতি ভক্তি নিদর্শনের উদ্দেশ্যে তাপনিয়ন্ত্রিত ইমারত হিসেবে তোহাখানা নির্মাণ করেন।জনশ্রুতি আছে যে-শাহ সুজা যখন ফিরোজপুরে মোরশেদ শাহ নেয়ামতউল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাত করতে আসতেন তখন উক্ত ইমারতের মধ্যবর্তী সুপ্রশস্ত কামরাটিতে বাস করতেন। তোহাখানা কমপ্লেক্সের ভেতরে আরো নাম না জানা অনেক সমাধি দেখা যায়। যাদের পরিয় এখনো জানা যায় নি। তবে এদেরকে হযরত শাহ সৈয়দ নেয়ামতউল্লাহর খাদেম বা সহচর বলে ধারনা করা হয়।

গৌড়ের প্রাচীন কীর্তির মধ্যে এই শ্রেণীর ইমরাত এই একটিই পরিলক্ষিত হয়। কড়িকাঠের উপর খোয়া ঢালাই করে যার ছাদ ও কোঠা জমাট করা হয়েছিল। উল্লেখিত মসজিদ ও তাহখানার নিকটস্থ সরোবর দাফেউল বালাহর তীরে অবস্থিত। এই দুই ইমারত হতে দুইটি সিড়ি সরোবরের তলদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত। ভবনটির উত্তর-পশ্চিমে আরও দুটি কাঠামো রয়েছে নিকটস্থটি একটি তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ এবং একটু উত্তরে অবস্থিত অপরটি ভল্টেড বারান্দা ঘেরা একটি গম্বুজ সমাধি। যেহেতু ভবনগুলো একই সময় একটি বিশেষ উদ্দেশ্যেই নির্মিত হয়েছিল, সেহেতু সব ভবনকে একত্রে একটি একক ইউনিট বা একটি কমপ্লেক্স হিসেবে গণ্য করা হয়। এ ভবনটি মূলত ইট নির্মিত। তবে দরজার চৌকাঠের জন্য কালো পাথর এবং সমতল ছাদের জন্য কাঠের বিম ব্যবহৃত হয়েছে। পশ্চিম দিক থেকে ভবনটিকে দেখলে একতলা মনে হয়, পূর্বদিক থেকে অবশ্য দ্বিতল অবয়বই প্রকাশ পায়, যার নিচতলার কক্ষগুলো পূর্বদিকে বর্ধিত এবং খিলানপথগুলো উত্থিত হয়েছে সরাসরি জলাশয়টি থেকে। ভবনের দক্ষিণ পাশে রয়েছে একটি গোসলখানা যেখানে পানি সরবরাহ হতো একটি অষ্টভুজাকৃতির চৌবাচ্চার মাধ্যমে জলাশয় থেকে। উত্তর পাশে একটি ছোট পারিবারিক মসজিদ অবস্থিত, এর পেছনে রয়েছে একটি উন্মুক্ত কক্ষ যেটি একটি অষ্টভুজাকার টাওয়ার কক্ষের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। এ টাওয়ার কক্ষটি সম্ভবত ধ্যানের জন্য ব্যবহৃত হতো। অষ্টভুজাকার টাওয়ারটি সব কমপ্লেঙ্টিতে ভারসাম্য প্রদান করেছে। প্রাসাদটি প্লাস্টার করা এবং খোদাইকৃত। এসব অলঙ্করণ রীতি মোঘল আমলের।

চন্দ্রমহল


চন্দ্রমহল নামে একটি ভবনকে কেন্দ্র করে বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলায় রঞ্জিতপুর গ্রামের কাছে একটি পিকনিক স্পট রয়েছে। এটি আসলে একটি চমৎকার শিল্প নিদর্শন। তাজমহলের আদলে তৈরি চন্দ্রমহল।
 ২০০২ সালে চন্দ্রমহলের প্রতিষ্ঠাতা সেলিম হুদা তার স্ত্রী নাসিমা হুদা চন্দ্রার নামানুসারে প্রায় ৩০ একর জমির উপরে এই ইকোপার্কটি তৈরী করেন। চন্দ্রমহলের সৌন্দর্য দেখে যে কোন পর্যটক মুগ্ধ হবেন। বিশেষ করে প্রখর রোদের আলো যখন মহলের উপরি অংশের সোনালী অংশে পরে তখন এটি দেখে মনে হয় দামী ধাতব পদার্থে নির্মিত হয়েছে মহলটি। মহলটি পানি দ্বারা বেষ্টিত। মহলে পৌছানোর জন্য পানির নিচ থেকেই নেয়া হয়েছে পাকা রাস্তা। 
রাস্তার মাঝপথে গেলেই দর্শণার্থীদের চোখে পরবে পুরু কাঁচের উল্টো পাশের বড় বড় মাছ। স্থানীয় লোকদের ধারনা শীত মৌসুমে সুন্দরবন দেখতে লাখ লাখ মানুষের আগমন ঘটে। আর সুন্দরবন যাওয়ার পথে চন্দ্র মহলের অবস্থান বিধায় সুন্দরবনের দর্শণার্থীদের একটি বড় অংশ চন্দ্র মহল দেখতে আসেন। যে কারনে অন্যান্য পার্কের তুলনায় চন্দ্রমহলে পর্যটকদের ভীর কিছুটা বেশি।পর্যটকদের জন্য এখানে নির্মান করা হয়েছে নানান প্রস্তর শিল্প, মৃত্তিকা শিল্প, বাশ ও বেত শিল্পের মানুষ ও প্রাণীর মূর্তি। মাটি দ্বারা নির্মিত হয়েছে পল্লী সংস্কৃতির নানান স্মৃতিকথা, গ্রামীণ নারীর জীবনযাত্রার বিমূর্ত ছবি ফুটে উঠেছে এ শিল্পে। জেলে, কৃষক, ধোপা ইত্যাকার নানান পেশাজীবী গ্রামীণ মানুষের মধ্যযুগের জীবনযাত্রা কেমন ছিল তার ধারনা দিতেই নির্মিত হয়েছে এ মাটির শিল্প।
 এখানে রয়েছে পানির উপর বাঁশের তৈরি কুটির ও রেস্তরা, ছোট ছোট দিঘীগুলোতে রয়েছে মাছ চাষ, পুকুরের মধ্যে ইট-সিমেন্টের তৈরি কাকড়া ও ঝিনুক, পানসী নৌকা, ১৯৭১ সালের রাজাকারের জন্য কৃত্তিম ফাঁসির মঞ্চ, ডাইনোসরের মূর্তি, কৃত্তিম রেল লাইন, বাঘ-ঘোড়া-হরিণের মূর্তি। পর্যটকদের জন্য রয়েছে পিকনিক স্পট। একটি কাঠের তৈরি বড় ঘর ও তার পাশে রয়েছে রান্নার সকল ব্যাবস্থা। দর্শণার্থীরা নিজেদের মত করে যাতে পিকনিক করতে পারে সে বিবেচনা করেই এ ব্যাবস্থা রাখা হয়েছে। 
ইকোপার্কের প্রায় সর্বত্রই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে নানান প্রকারের সবজি চাষ, প্রচুর ফলজ বৃক্ষও রোপন করা হয়েছে। রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির আম চাষ। পার্কের চারধারে লাগানো হয়েছে অসংখ্য নারিকেল গাছ। আর এই বিভিন্ন প্রকারের গাছ ও সবজি চাষই ইকোপার্কের মধ্যে প্রাকৃতিক পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছে।বণ্য প্রাণীদের সাথে পরিচয় করানোর জন্য এখানে আনা হয়েছে অনেক প্রজাতির পশু-পাখি। এদের মধ্যে বানর, বনবিড়াল, হরিণ, তিতপাখি, তুর্কী মুরগী, সাদা ময়ূর, বক, বিভিন্ন প্রজাতির কুকুর ঈগল, মদন টাক পাখি, সাদা ঘুঘু-হাস পাখি, পেঁচা, বেজী, কবুতর, কোয়েল, কুমির ইত্যাদির নাম উল্লেখযোগ্য। 
পার্কের মূল মহলের মধ্যে রাখা হয়েছে নানান প্রত্নতত্ব। এদের মধ্যে বিশেষ করে দেশী-বিদেশী পুরনো মুদ্রা, ডাক টিকিট, যুদ্ধের অস্ত্র, বহুকাল আগের তৈরি ঘড়ি, প্রার্থণার অলংকার, ধর্মীয় পুরাকীর্তি, সিঁদুর দানী, পাথরের আসবাবপত্র, বিভিন্ন রঙের পাথর, শত বছরের পুরনো কলেরগান, সবচেয়ে ছোট গ্রামোফোন, বিরল পান্ডুলিপি, বাঁশ পোকা, বিভিন্ন প্রজাতির মৃৎ শিল্প, বিভিন্ন প্রকার ক্ষুদ্র পতঙ্গ, পাতা পোকা, ১৭০০-১৮০০ সালের পিতলের চুলের কাটা, রুপার চায়ের পাত্র, পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম কোরআন শরীফ, আড় বাঁশি ইত্যাদির নাম উল্লেখযোগ্য।
সময়সূচীঃ
প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত চন্দ্রমহল ইকোপার্কটি খোলা থাকে।
টিকেট মূল্যঃ
প্রবেশের জন্য ৪০ টাকা মূল্যের টিকিট কাটতে হবে।
খাওয়া দাওয়াঃ
পর্যটকদের চাহিদা পূরনের জন্য ইকোপার্কের মধ্যেই গড়ে উঠেছে ৮-১০টি বিভিন্ন প্রকারের রেস্তরা।

Travel

ঘুরে আসুন হামহাম জলপ্রপাত

প্রকৃতির অপরূপ লীলাভুমি মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলায় নতুন সন্ধান পাওয়া রোমাঞ্চকর নয়নাভিরাম হামহাম জলপ্রপাত একনজর দেখার জন্য দেশের বিভ...